‘চাকরি নয় সেবা’ প্রতিপাদ্যে বাংলাদেশ পুলিশে প্রথমবারের মতো নতুন নিয়োগবিধি অনুযায়ী ট্রেইনি রিক্রুট কনস্টেবল নিয়োগ প্রক্রিয়া গতকাল শুক্রবার সম্পন্ন হয়েছে। কোনো ধরনের তদবির কিংবা অর্থের লেনদেন ছাড়াই নিরপেক্ষভাবে সম্পূর্ণ স্বচ্ছতার ভিত্তিতে এ নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়। এবারের কনস্টেবল পদে অত্যন্ত সাধারণ পরিবারের যেমন- দিনমজুর, কৃষক, ভ্যানচালকের সন্তানরাই নিয়োগ পেয়েছেন।
শনিবার (২৭ নভেম্বর) রাতে পুলিশ সদরদপ্তরের এআইজি (মিডিয়া অ্যান্ড পিআর) মো. কামরুজ্জামান এ তথ্য জানান।
তিনি জানান, মেধা ও শারীরিক দিক থেকে অধিক যোগ্য প্রার্থী নিয়োগের লক্ষ্যে পুলিশের কনস্টেবল পদে নিয়োগ প্রক্রিয়া শুরু হয় গত ২৫ অক্টোবর। তিন হাজার শূন্যপদের বিপরীতে আবেদনকারীর সংখ্যা ছিল তিন লাখ ৩৮ হাজার ৫৩৪ জন। এর মধ্যে প্রাথমিক বাছাইয়ে উত্তীর্ণ হন এক লাখ ১৭ হাজার ৬৮ জন। তাদের মধ্যে পুরুষ এক লাখ ৬৩৪ জন ও নারী ১৬ হাজার ৪৩৪ জন।
শারীরিক সক্ষমতা যাচাই শেষে ২৩ হাজার ৬৯৭ প্রার্থী লিখিত পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেন। যার মধ্যে ২১ হাজার ৭৫৯ জন পুরুষ এবং এক হাজার ৯৩৮ জন নারী। লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ সাত হাজার ৪০০ জন প্রার্থীর মধ্যে চূড়ান্ত নিয়োগ পেয়েছেন তিন হাজার।
সংশোধিত নিয়োগবিধি অনুযায়ী কনস্টেবল নিয়োগের অন্যতম প্রধান লক্ষ্য ছিল মেধা ও শারীরিক সক্ষমতার দিক থেকে অধিকতর যোগ্য প্রার্থী নিয়োগ করা। দেশের ৬৪ জেলায় কনস্টেবল নিয়োগ এক অভূতপূর্ব সাড়া ফেলেছে। কোনো ধরনের তদবির কিংবা অর্থের লেনদেন ছাড়াই নিরপেক্ষভাবে সম্পূর্ণ স্বচ্ছতার ভিত্তিতে এ নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়েছে।
কোনো ধরনের তদবির বা অর্থছাড়া কনস্টেবল পদে চাকরি পাওয়া সাধারণ পরিবারের সন্তান এবং তাদের পিতা-মাতার জন্য ছিল স্বপ্নের মতো।
এসব পরিবারের সন্তানদের কাছে মাত্র ১৩৩ টাকা ফি দিয়ে পুলিশের চাকরি পাওয়া ছিল স্বপ্নাতীত। চাকরি পেয়ে অনেকের চোখ ভিজে উঠেছিল আনন্দ অশ্রুতে। সন্তানের চাকরি পাওয়ার খুশিতে আবেগ ধরে রাখতে পারেননি তাদের পিতা-মাতাও। দেশের ৬৪ জেলার প্রায় প্রতিটিতেই এমন আবেগঘন দৃশ্য চোখে পড়ে।
পিআরবি পরিবর্তনের মাধ্যমে মেধা ও শারীরিক যোগ্যতার ভিত্তিতে কনস্টেবল পদে সাত ধাপে নিয়োগ প্রক্রিয়ার প্রথম ধাপে প্রাথমিক বাছাই, দ্বিতীয় ধাপে শারীরিক মাপ এবং ফিজিক্যাল অ্যানডুরেন্স টেস্ট, তৃতীয় ধাপে লিখিত পরীক্ষা,
চতুর্থ ধাপে মনস্তাত্ত্বিক ও মৌখিক পরীক্ষা, পঞ্চম ধাপে প্রাথমিক নির্বাচন, ষষ্ঠ ধাপে পুলিশ ভেরিফিকেশন ও স্বাস্থ্য পরীক্ষা এবং সপ্তম ও সর্বশেষ ধাপ হলো চূড়ান্তভাবে প্রশিক্ষণে অন্তর্ভুক্তকরণ। প্রার্থীদের শারীরিক সক্ষমতা সাতটি ইভেন্টের মধ্য দিয়ে যাচাই করা হয়েছে। এগুলো হলো- দৌড়, পুশ আপ, লং জাম্প, হাইজাম্প, সিট আপ, ড্র্যাগিং এবং রোপ ক্লাইম্বিং।
পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, আইজিপি ড. বেনজীর আহমেদ নতুন নিয়মে কনস্টেবল নিয়োগের লক্ষ্যে প্রথমেই পিআরবি সংশোধনের উদ্যোগ গ্রহণ করেন।
পিআরবি সংশোধন শেষে সফলতার সঙ্গে নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা এবং প্রার্থীদের নিয়োগ প্রক্রিয়ার সঙ্গে অভ্যস্ত করার লক্ষ্যে খাগড়াছড়িতে এপিবিএন’র বিশেষায়িত প্রশিক্ষণকেন্দ্রে দীর্ঘদিন ধরে পরীক্ষার প্রতিটি ধাপ সম্পর্কে বাস্তবভিত্তিক ভিডিও ধারণ করা হয়। এ ভিডিও পুলিশের ফেসবুক পেজসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এবং ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় ব্যাপকভাবে প্রচার করা হয়। গবেষণার ভিত্তিতে টাঙ্গাইল জেলা থেকে নমুনা সংগ্রহ করে পিটিসি টাঙ্গাইলে ‘মক’ নিয়োগ পরীক্ষারও আয়োজন করা হয়।
প্রার্থীদের নতুন নিয়মে নিয়োগ পরীক্ষায় অভ্যস্ত করতে শারীরিক সক্ষমতা যাচাইয়ের জন্য সারদায় বাংলাদেশ পুলিশ একাডেমি, এপিবিএনসহ অন্যান্য প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানে বিভিন্ন পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের দিয়ে শারীরিক সক্ষমতা যাচাইয়ের ইভেন্টসমূহের অনুশীলন ইভেন্ট পরিচালনা করে শারীরিক সক্ষমতা যাচাই পরীক্ষার প্রস্তুতি গ্রহণ করা হয়।
মাঠ পর্যায়ে কনস্টেবল নিয়োগ পরীক্ষা সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য নিয়োগ সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তাদের জন্য একাধিক ট্রেনিং অব ট্রেইনার্স (টিওটি) কোর্সের আয়োজন করা হয়েছে।
অনলাইনে আবেদন গ্রহণ এবং ওয়েব বেইজড স্ক্রিনিংয়ের মাধ্যমে কনস্টেবল নিয়োগ পরীক্ষা ডিজিটালাইজেশন করা হয়েছে।
কনস্টেবল নিয়োগকে কেন্দ্র করে কেউ যাতে অসাধু পন্থা অবলম্বন করতে না পারে সেজন্য পুরো নিয়োগ প্রক্রিয়া চলাকালীন পুলিশ অত্যন্ত তৎপর ও সচেষ্ট ছিল। কয়েকটি জেলায় কনস্টেবল নিয়োগে প্রতারণার অভিযোগে প্রতারকদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে।
কনস্টেবল নিয়োগ সম্পর্কে বাংলাদেশ পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) ড. বেনজীর আহমেদ তার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে বলেন, প্রধানমন্ত্রীর সুযোগ্য দিকনির্দেশনা ও সার্বিক তত্ত্বাবধানে বাংলাদেশ পুলিশকে উন্নত দেশের উপযোগী পুলিশ হিসেবে গড়ে তোলার লক্ষ্যে কাজ করছি। এবারের কনস্টেবল নিয়োগ সে প্রক্রিয়ারই অংশ। এজন্য বর্তমান নিয়োগবিধি সংশোধন করা হয়েছে। নিয়োগবিধি সংশোধনে সার্বিক সহায়তা প্রদানের জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট সকলকে ধন্যবাদ জানান তিনি।
তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রীর দুর্দমনীয় সাহস ও সুযোগ্য নেতৃত্বে ২০৪১ সালে বাংলাদেশ উন্নত দেশে পরিণত হবে।
আমরা পুলিশকেও উন্নত দেশের উপযোগী হিসেবে গড়ে তোলার লক্ষ্যে মেধা ও শারীরিকভাবে অধিক যোগ্য প্রার্থীদের কনস্টেবল পদে নিয়োগ করেছি। অত্যন্ত স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষতার ভিত্তিতে নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করায় তিনি সংশ্লিষ্ট সকলকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানান।
আইজিপি আরও বলেন, ভবিষ্যতে পুলিশের সাব-ইন্সপেক্টর এবং সার্জেন্ট পদে নিয়োগের ক্ষেত্রেও মেধা ও শারীরিক যোগ্যতাসম্পন্ন প্রার্থীরাই নিয়োগ পাবেন।